Background

হূদয়ের ‘চকলেট পাঠশালা’

মোবারক হোসেনকে এখন আর কেউ ‘পাগল’ বলে না। তাঁর চকলেট পাঠশালাটি নিয়েও মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। বহু দূরের মানুষজনও আসে চকলেট পাঠশালার গল্পটি জানতে। মোবারক হোসেন এখন সবার প্রিয় চকলেট স্যার। যাঁকে পরিচিতজনেরা চেনেন ‘হূদয়’ নামেই। হূদয় জন্মেছেন কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতি ইউনিয়নের কান্দিগ্রামে। এই গ্রামের হাজার দুই লোকজন অধিকাংশই নিজের নাম লিখতে পারে না। হূদয় গ্রামের মানুষকে আলোর পথ দেখানোর দায়িত্ব নেন। সেই স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় সাত বছর আগে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ২৫ জন শিশুকে নিয়ে নিজ বাড়ির গাছতলায় চট বিছিয়ে শুরু হয় তাঁর অক্ষরবিদ্যার কার্যক্রম। চক, ডাস্টার, ব্ল্যাকবোর্ড, পরীক্ষা—সবই হয় আর সব বিদ্যালয়ের মতোই। তবে পার্থক্য, শিক্ষক একজন, বিদ্যালয়ের ভবন নেই এবং সবচেয়ে বড় পার্থক্য, তিনি তাঁর কাজের জন্য আর্থিক বিনিময় গ্রহণ করেন না।

শুরুতে শিক্ষার্থী কম থাকলেও হূদয়ের একটি বিশেষ উদ্যোগ বড় সুফল নিয়ে আসে। সপ্তাহে এক দিন তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে চকলেট বিতরণ করেন। এখন তাঁর পাঠশালার শিক্ষার্থী ১০০ ছাড়িয়েছে। আর এই উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি প্রিয় শিক্ষার্থী আর গ্রামবাসীর কাছে হয়ে উঠেছেন ‘চকলেট স্যার’।  ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর বিশাল বাংলায় ‘হূদয়ের চকলেট পাঠশালা’ শিরোনামে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের পর পাঠশালাটি নিয়ে দেশ-বিদেশের মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিধিদল এসে পাঠশালাটি দেখে যায়। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাঙালিরা ই-মেইল ও চিঠির মাধ্যমে হূদয়কে অভিনন্দন জানান। স্থানীয় শিক্ষা অফিস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে হূদয়কে নানাভাবে সম্মানিত করা হয়। সেই সঙ্গে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে হূদয়ের চকলেট পাঠশালায়। ফলে, পাঠশালাটির অবকাঠামোয় আসে পরিবর্তন। গাছতলা থেকে শিক্ষার্থীরা উঠে আসে ছাপরাঘরে।
 
২০ মার্চ সরেজমিন পাঠশালায় গিয়ে দেখা যায়, ছাপরাঘরটির চট বিছানো মেঝেতে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে হূদয় যথারীতি আপন মনে পড়াচ্ছিলেন, ‘অ-তে অজগর, আ-তে আম...’। তাল ও ছন্দে শিশুরা স্যারকে অনুসরণ করে শেখার চেষ্টা করছে। এই পাঠশালায় কতটা ভালো পাঠদান হয়, তার প্রমাণ দিল শিক্ষার্থীরা নিজেই। হিরামনি নামের ছোট্ট মেয়েটি এক বারে এক থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত নির্ভুল গণনা করল। ছোট্ট ফাহিম শোনাল এ, বি, সি, ডি। পাঠদানের পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে বিনোদন ও সাংস্কৃতিক চর্চাও হয় এখানে। অক্ষরবিদ্যা বিলিয়ে হূদয় কোনো পারিশ্রমিক পান না; বরং মাস শেষে তাঁকে অন্তত ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার জোগাড় রাখতে হয়। আয়ের উৎস হিসাবে বেছে নিয়েছেন প্রাইভেট পড়ানোর কাজ। বেশি অর্থসংকটে পড়লে এখনো কিছুদিনের জন্য জুতার শ্রমিকের খাতায় নাম লেখাতে হয় তাঁকে।

পাঠশালায় সরকারি ছুটি ও অসুস্থতাজনিত সমস্যা ছাড়া সপ্তাহে পাঁচ দিন ক্লাস হয়। অক্ষরজ্ঞান দেওয়ার পর হূদয় তাঁর দায়িত্ব থেকে সরে আসেন না। পরে অভিভাবকদের বুঝিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান শিশুদের। হূদয়ের দেওয়া হিসাবমতে, সাত বছরে তাঁর পাঠশালার পাঠ শেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী। হূদয়ের মা নাহুদা খাতুন বলেন, ‘পাঠশালা শুরুর দিকে গ্রামের মানুষ হূদয়কে ‘‘পাগল’’ বলত। এখন আর আমার ছেলেকে কেউ পাগল বলে না। উল্টো সম্মান করে।’

 
সাইফুল হক মোল্লা ও সুমন মোল্লা কিশোরগঞ্জ
তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, বাংলাদেশ। 

aas