Background
আট বছরের শিশু সাইদ কাজ করে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে একটি বেলুন তৈরির কারখানায়। বাবা ময়লার ভ্যানচালক। মা বাসাবাড়িতে কাজ করেন। সাইদ সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ করার পর বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাতে বাড়ি ফেরে। এত পরিশ্রমের পর সপ্তাহে জোটে মাত্র ৩০০ টাকা। অর্থাৎ মাসে এক হাজার ২০০ টাকা। সাজেদের বড় ভাই মো. রিটু (১৬) পাশের আরেকটি বেলুন তৈরির কারখানায় কাজ করে। বয়সে বড়, তাই শরীরে শক্তিও বেশি আর কাজেও দক্ষ বলে প্রতি সপ্তাহে ৫০০ টাকা করে পায় জানায়। সাইদ বলে, ‘মজুরি কম হইলে কি আর করতাম। যা দেয় তাতেই খুশি। আর কাম না করলে তো না খাই থাকন লাগে।’ ময়না (১২) গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে রাজধানীর আজিমপুরের একটি বাড়িতে। ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, ঘরবাড়ি গোছানো, থালাবাসন ধোয়া, বাচ্চা দেখাশোনা—এসব কাজ তাকে করতে হয়। মাস শেষে তাকে দেওয়া হয় এক হাজার টাকা। বেতন বাড়াতে বললে গৃহকর্ত্রী বলেন, ‘তোর খাওয়া আর জামা-কাপড়ের পেছনে অনেক টাকা যায়। এর বেশি দেওয়া সম্ভব নয়।’ তবে লাইলির অবস্থা আরও খারাপ। শান্তিবাগের একটি বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল আট মাস আগে। এই আট মাসে তাকে কোনো বেতন দেওয়া হয়নি।

রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাড়িতে কাজ করে ফরিদ (৮)। গৃহকর্তার ছেলে জিসানের (ছদ্মনাম) স্কুলের ব্যাগ বহন করা তার প্রধান কাজ। স্কুল শেষে জিসানের সঙ্গে সে হেঁটেই বাড়ি ফেরে। প্রায় একই বয়সের দুই শিশু একজন ব্যাগ টানার কাজ করে, আর অন্যজন স্কুল থেকে আইসক্রিম খেতে খেতে বাসায় ফেরে। জিসানের যখন স্কুল চলছিল, তখন কথা হয় ফরিদের সঙ্গে। সে জানায়, কাজ করে মাসে ৫০০ টাকা পায় সে। দুই বেলা খেতে দেয়। সকালে স্কুলে চলে আসে। তাই একবারে দুপুরে খায়, সকালে আর খাওয়া হয় না তার। স্কুলে যাতায়াত করা ছাড়াও ফরিদকে প্রতিদিন ময়লা ফেলা, ঘর মোছাসহ বিভিন্ন কাজ করতে হয়। ফরিদ বলে, ‘টেকার জন্যি বাবা-মায়ে কামে পাডাইছে। সেই টেকাই পাই না।’
 
হিরণ মিয়া লেগুনায় হেলপারের কাজ করে। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাবা বসিলায় রিকশা চালান। বাবার ইচ্ছায় স্কুলে না গিয়ে সে কাজে এসেছে। বেতন কত জিজ্ঞেস করতেই হিরণ বলে, ‘বেতন কী আফা?’ প্রতি ট্রিপে ২০ টাকা করে দেয়। আবার যাত্রী বেশি না হলে তা-ও পায় না কখনো। হিরণ বলে, ‘এসব টাকায় সংসার চলবার চায় না। কিন্তু কী করুম। এই কাম না করলে তো আরও বিপদ। খামু কী।’ হিরণ জানায়, একবার লেগুনার হ্যান্ডেল থেকে হাত ফসকে পড়ে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছিল। তখন দুই মাস পঙ্গু হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল তাকে। রাজধানী কারওয়ান বাজারের একটি দোকানে কাজ করে ১০ বছরের শিশু শিপন। মাস শেষে সে পায় ৮০০ টাকা। সারা দিন কাজ করলেও মালিক তাকে কোনো বেলায়ই খেতে দেন না। শিপন বলে, ‘সংসারে যাতে টেকা দিবার পারি, হের লাইগ্যা এইহানে কাম করতে আইছি। কিন্তু যে বেতন পাই, এই দিয়া তো ঠিকমতো খাওনই জুডে না।’

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) চেয়ারপারসন এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, শিশুরা ভোটার নয়, তাই শিশুদের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর খুব একটা মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার হলেও তাদের উন্নয়ন নিয়ে কেউ খুব একটা চিন্তিত নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ১৪ বছরের নিচে বয়স, এমন শিশুদের শ্রমে নিয়োগ দেওয়া নিষিদ্ধ হলেও অনেকে এ বিষয়ে জানে না। আবার জানলেও তারা শ্রমিক হিসেবে শিশুদের নিয়োগ দিতেই পছন্দ করে। এ ব্যাপারে সরকারকে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। শিশুশ্রমিকেরা যাতে যথাযথ মজুরি পায়, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।
- সাবিনা ইয়াসমিন 

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা

আবদুর রহিমের বয়স ১০ বছর। সে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে একটি লেদ কারখানায় কাজ করে। মলিন মুখ, শরীরের এখানে-সেখানে কালিমাখা, হাতে কাটাছেঁড়ার দাগ আর ধুলামাখা চুল তার। রংচটা পোশাকেও অনেক দাগ লেগে আছে। ১৮ মার্চ রাত ১০টায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যখন রহিমের কথা হয় তখন সে কারখানার সারা দিনের জমে থাকা ময়লা ঝাড়ু দিচ্ছিল। রহিম জানায়, সকাল নয়টায় কারখানায় এসেছে। রাত ১১টায় কারখানা বন্ধ হলে তবেই ঘরে ফিরবে। এভাবেই এক বছর ধরে এ কারখানায় কাজ করছে। সারা দিন লোহা কাটার জন্য হাতুড়ি পেটানো, ভারী লোহার যন্ত্র আনা-নেওয়া, লোহা কাটা, মেশিন মেরামতসহ নানা ধরনের কাজ করতে হয় তাকে। এ কাজ করতে গিয়ে অনেকবার তার হাত কেটে গিয়েছে। হাতে ব্যথাও পেয়েছে অনেকবার। এ ছাড়া কারখানার কাজের পাশাপাশি মালিকের ফরমাশও মেনে চলতে হয় তাকে।

ধানমন্ডি ১৫ নম্বর সড়কে একটি ওয়ার্কশপে কাজ করে মহিন মিয়া (১২)। এখানে লোহা ঝালাইয়ের কাজ করে সে। প্রতিরোধক হিসেবে চশমা ব্যবহারের কথা থাকলেও শিশুটির চোখে তা নেই। হাজারীবাগের চামড়া কারখানার বর্জ্য যেখানে গিয়ে পড়েছে, সেখানে টুকরা টুকরা চামড়া কুড়ানোর কাজ করে ১১ বছরের হিরণ। রাসায়নিকমাখা বর্জ্য থেকে সে চামড়া কুড়িয়ে তা শুকানোর পরে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে। এ ছাড়া পশুর শিং, হাড়ও কুড়ায় সে। হিরণ জানায়, এ কাজ করতে তার ভালো লাগে না। বাধ্য হয়ে করে। বাবা পঙ্গু, কাজ করতে পারে না। মা পরের বাড়িতে কাজ করে। সংসারে আরও ছোট দুই বোন আছে তার। সবার কথা চিন্তা করেই সে কাজে নেমেছে।

জিগাতলা থেকে ফার্মগেটে যাওয়া হিউম্যান হলারে হেলপারের কাজ করে ফিরোজ (১২)। প্রতিদিন ঝুলতে ঝুলতে সে কাজ করে। কয়েক দিন আগে সে হলার থেকে পড়ে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যথা পায়। ফিরোজ বলে, ‘যাত্রী উডানোর পর আমারে ছাড়াই গাড়ি রওনা দেয়। দৌড় দিয়া গাড়িতে উঠছি ঠিকই, কিন্তু তাল সামলাতে না পাইরা পইড়া যাই। এরপর সাত দিন কামে আইতে পারি নাই, হেই সাত দিনের বেতন কাডা গেছে।’ নয় বছরের শিশু নাজমা কাজ করে রাজধানীর মালিবাগের একটি বাড়িতে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া সবই করতে হয় তাকে। এক দিন ভাতের ফ্যান গলাতে গিয়ে গরম ফ্যান হাতে পড়ে। এতে তার হাত পুড়ে যায়। আরেক দিন বাসায় পানি ছিল না। নিচে রিজার্ভ ট্যাংক থেকে বালতি ভর্তি করে পানি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নাজমা বালতিসহ পড়ে যায়। এতে তার পা মচকে যায়।

দেশে বিদ্যমান শিশু আইনে শিশুদের দিয়ে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো সম্পূর্ণ বেআইনি। সরকার ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ১৮২ নম্বর সনদে স্বাক্ষর করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বহু শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। এসব কাজ করতে গিয়ে শিশুরা নানা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া অনেকে নানা রোগব্যাধিরও শিকার হচ্ছে। তাদের মানসিক বিকাশও ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ঠিক কত শিশু কাজ করে, এ ধরনের কোনো পরিসংখ্যান জানে না শ্রম মন্ত্রণালয়। এমনকি কী কী ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে তারও সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা নেই তাদের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে বর্তমান কোনো পরিসংখ্যান নেই।’ তিনি জানান, কোনো কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে তাঁর সুনির্দিষ্ট তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই, তবে এ বিষয়ে আমাদের ধারণা আছে। তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের ফিরিয়ে আনতে সরকার একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। এর আওতায় ৫০ হাজার শিশুকে এসব কাজ থেকে ফিরে এনে শিক্ষা, ভাতা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এটি বর্তমানে তৃতীয় পর্যায়ে চলছে। শিগগিরই চতুর্থ পর্যায়ে বর্ধিত করা হবে।

দীর্ঘদিন ধরে দেশে এবং বিদেশে মানবদেহে ঢুকে পড়া ক্রোমিয়ামের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবুল হোসেন। তিনি জানান, চামড়াশিল্পে ব্যবহূত রাসায়নিক মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। চামড়া শিল্পগুলোতে পশুর চামড়া প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রচুর ক্রোমিয়াম ব্যবহূত হয়। ট্যানারি শিল্পে শিশুরা যেভাবে খালি গায়ে ও খালি হাতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে, তাতে এ রাসায়নিক প্রবেশ করে তাদের ফুসফুসে ও চামড়ায় ক্যানসার হতে পারে। এ ছাড়া নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দিতে পারে।
 
এ প্রসঙ্গে বারডেম হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান তাহমিনা বেগম বলেন, প্রতিরোধক ছাড়া ঝালাই কারখানায় কাজ করার কারণে শিশুরা অল্প বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারায়। বিভিন্ন স্থানে সঠিক কর্মপরিবেশের অভাবে শিশুরা ময়লা হাতেই খাবার খায়। এতে শিশুদের নানা ধরনের পেটের অসুখ হয়ে থাকে। যেসব শিশু বাসাবাড়িতে কাজ করে তাদের দিয়ে ভারী বালতি টানা, কাপড় ধোয়ার মতো কঠিন কাজ করানো হয়। এতে মেরুদণ্ডে ক্ষতি হয়। আর বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে শিশুরা যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, তাতে করে তারা মানসিকভাবে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এতে তাদের মানসিক বিকাশও ব্যাহত হয়।




তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, বংলাদেশ।
মোবারক হোসেনকে এখন আর কেউ ‘পাগল’ বলে না। তাঁর চকলেট পাঠশালাটি নিয়েও মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। বহু দূরের মানুষজনও আসে চকলেট পাঠশালার গল্পটি জানতে। মোবারক হোসেন এখন সবার প্রিয় চকলেট স্যার। যাঁকে পরিচিতজনেরা চেনেন ‘হূদয়’ নামেই। হূদয় জন্মেছেন কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতি ইউনিয়নের কান্দিগ্রামে। এই গ্রামের হাজার দুই লোকজন অধিকাংশই নিজের নাম লিখতে পারে না। হূদয় গ্রামের মানুষকে আলোর পথ দেখানোর দায়িত্ব নেন। সেই স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় সাত বছর আগে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ২৫ জন শিশুকে নিয়ে নিজ বাড়ির গাছতলায় চট বিছিয়ে শুরু হয় তাঁর অক্ষরবিদ্যার কার্যক্রম। চক, ডাস্টার, ব্ল্যাকবোর্ড, পরীক্ষা—সবই হয় আর সব বিদ্যালয়ের মতোই। তবে পার্থক্য, শিক্ষক একজন, বিদ্যালয়ের ভবন নেই এবং সবচেয়ে বড় পার্থক্য, তিনি তাঁর কাজের জন্য আর্থিক বিনিময় গ্রহণ করেন না।

শুরুতে শিক্ষার্থী কম থাকলেও হূদয়ের একটি বিশেষ উদ্যোগ বড় সুফল নিয়ে আসে। সপ্তাহে এক দিন তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে চকলেট বিতরণ করেন। এখন তাঁর পাঠশালার শিক্ষার্থী ১০০ ছাড়িয়েছে। আর এই উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি প্রিয় শিক্ষার্থী আর গ্রামবাসীর কাছে হয়ে উঠেছেন ‘চকলেট স্যার’।  ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর বিশাল বাংলায় ‘হূদয়ের চকলেট পাঠশালা’ শিরোনামে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের পর পাঠশালাটি নিয়ে দেশ-বিদেশের মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিধিদল এসে পাঠশালাটি দেখে যায়। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাঙালিরা ই-মেইল ও চিঠির মাধ্যমে হূদয়কে অভিনন্দন জানান। স্থানীয় শিক্ষা অফিস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে হূদয়কে নানাভাবে সম্মানিত করা হয়। সেই সঙ্গে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে হূদয়ের চকলেট পাঠশালায়। ফলে, পাঠশালাটির অবকাঠামোয় আসে পরিবর্তন। গাছতলা থেকে শিক্ষার্থীরা উঠে আসে ছাপরাঘরে।
 
২০ মার্চ সরেজমিন পাঠশালায় গিয়ে দেখা যায়, ছাপরাঘরটির চট বিছানো মেঝেতে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে হূদয় যথারীতি আপন মনে পড়াচ্ছিলেন, ‘অ-তে অজগর, আ-তে আম...’। তাল ও ছন্দে শিশুরা স্যারকে অনুসরণ করে শেখার চেষ্টা করছে। এই পাঠশালায় কতটা ভালো পাঠদান হয়, তার প্রমাণ দিল শিক্ষার্থীরা নিজেই। হিরামনি নামের ছোট্ট মেয়েটি এক বারে এক থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত নির্ভুল গণনা করল। ছোট্ট ফাহিম শোনাল এ, বি, সি, ডি। পাঠদানের পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে বিনোদন ও সাংস্কৃতিক চর্চাও হয় এখানে। অক্ষরবিদ্যা বিলিয়ে হূদয় কোনো পারিশ্রমিক পান না; বরং মাস শেষে তাঁকে অন্তত ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার জোগাড় রাখতে হয়। আয়ের উৎস হিসাবে বেছে নিয়েছেন প্রাইভেট পড়ানোর কাজ। বেশি অর্থসংকটে পড়লে এখনো কিছুদিনের জন্য জুতার শ্রমিকের খাতায় নাম লেখাতে হয় তাঁকে।

পাঠশালায় সরকারি ছুটি ও অসুস্থতাজনিত সমস্যা ছাড়া সপ্তাহে পাঁচ দিন ক্লাস হয়। অক্ষরজ্ঞান দেওয়ার পর হূদয় তাঁর দায়িত্ব থেকে সরে আসেন না। পরে অভিভাবকদের বুঝিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান শিশুদের। হূদয়ের দেওয়া হিসাবমতে, সাত বছরে তাঁর পাঠশালার পাঠ শেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী। হূদয়ের মা নাহুদা খাতুন বলেন, ‘পাঠশালা শুরুর দিকে গ্রামের মানুষ হূদয়কে ‘‘পাগল’’ বলত। এখন আর আমার ছেলেকে কেউ পাগল বলে না। উল্টো সম্মান করে।’

 
সাইফুল হক মোল্লা ও সুমন মোল্লা কিশোরগঞ্জ
তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, বাংলাদেশ। 
মূল রচনা: হুইলচেয়ারকে সঙ্গী করে ঘুরেছেন বিশ্বের ১৯টি দেশ। বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছেন প্রতিবন্ধীদের জন্য তহবিল গঠনের প্রস্তাব। পড়ুন নাটোরের প্রতিবন্ধী যুবক মো. মহরম আলীর বাধা পেরোনোর অসামান্য গল্প 

তখন সবে দেড় বছর বয়স তার। একটু-আধটু কথা বলা শুরু করেছে মাত্র। হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে হাঁটতেও শিখেছে খানিকটা। এটুকু বয়সেই তাকে নামতে হলো নিজেকে সচল রাখার যুদ্ধে। পোলিও নামের কঠিন ব্যাধি থাবা মারল মহরম আলী নামের এই ছোট্ট শিশুর জীবনে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো পোলিওর সঙ্গে যোগ হয়
হাতুড়ে কবিরাজের চিকিৎসা। ফলাফল, সে যাত্রায় পুরোপুরি পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয় নায়ক মহরম আলীকে। প্রশ্ন জাগতেই পারে, যে ছেলে গত ২৬ বছর হুইলচেয়ার ছাড়া চলতে পারে না, যে ছেলের জগৎ ছিল নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ, সে আবার নায়ক হয় কী করে! হ্যাঁ, মহরম আলী সত্যিকারের অর্থেই ব্যতিক্রমী এক নায়ক।
হুইলচেয়ারকে সঙ্গী করেই তিনি পৌঁছে গেছেন বিশ্বের ১৯টি দেশে। পাড়ি দিয়েছেন তিনটি মহাদেশ। নাড়া দিয়েছেন বিশ্বনেতাদের। মনে হচ্ছে অসম্ভব? এই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখিয়েছেন নাটোরের প্রতিবন্ধী যুবক মো. মহরম আলী।

 
শুরুর গল্প
২০১০ সাল। শারীরিক প্রতিবন্ধী মহরম আলী তখন সিআরপিতে (সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড) কর্মরত। ওই সময় একটা ঘটনা তাঁর মনে দাগ কাটে। মেক্সিকোর কানকুনে জলবায়ু সম্মেলন হচ্ছে। জলবায়ু নিয়ে বিশ্বনেতাদের আগাম চিন্তাভাবনা চমকিত করে তাঁকে। চাইলে প্রতিবন্ধীদের জন্যও এ রকম সম্মেলন বা তহবিল গঠন করা সম্ভব বলে মনে হতে থাকে তাঁর।
‘পৃথিবীতে এত এত প্রতিবন্ধী মানুষ অথচ তাঁদের জন্য কেউ এভাবে ফান্ড গঠন করার চিন্তা করে না। অথচ চাইলেই কিন্তু প্রতিবন্ধীদের সহজেই কাজে লাগানো যায়। স্বাভাবিক মানুষের মতোই কর্মদক্ষ করা যায়! সে বিষয়টা খুব কম লোকই ভাবে’—বলছিলেন মহরম আলী। এই চিন্তা থেকেই উদ্যোগটা নেন তিনি। তাঁর উদ্যোগের নাম দেন ‘ওয়ার্ল্ড ডিজঅ্যাবিলিটি ফান্ড’। সহজ ভাষায়, সারা বিশ্বের প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য একটি কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক তহবিল তৈরি করা। মহরম আলীর ভাষ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘসহ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনেক ধরনের তহবিল রয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর সব রাষ্ট্র বা সরকারের মিলিত (অল স্টেট ইনিশিয়েটিভ) কোনো কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক তহবিল নেই। এই চিন্তা থেকেই তিনি সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। তাঁর স্বপ্নের কথা বিশ্বনেতাদের জানানো প্রয়োজন মনে করেন তিনি।
কিন্তু একে তো উন্নয়নশীল দেশের প্রতিবন্ধী যুবক, তার ওপর পড়াশোনার দৌড়ও কম, তাই এমন চিন্তা আকাশকুসুমই মনে হচ্ছিল। পায়ের শক্তি কমে গেলে কী হবে, মহরমের মনের শক্তি যে তীব্র, সেটা বোঝা গেল অচিরেই। ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেন তিনি। শুরুতে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বিশ্বের কোথায় কোন সংগঠন কাজ করে, তার একটি তালিকা তৈরি করলেন। তারপর নিজের পরিকল্পনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেন। এমন চিন্তা কোনো সংগঠন বা দেশের নেই বললেই চলে। মহরম বলছিলেন, ‘শুরুতেই বুঝেছিলাম প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আমার তহবিল গঠনের প্রস্তাবটি বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিতে হলে ব্যতিক্রমী কিছু করতে হবে। তখনই বিশ্বভ্রমণের কথা মাথায় আসে।’ কিন্তু...!

শত বাধা পেরিয়ে...
‘ধরুন, আমি পরিকল্পনা ঠিক করলাম। তাই বলে সমস্যা কিন্তু পালিয়ে গেল না! আমার পুরো ভ্রমণের অর্থায়ন নিয়ে মহাসমস্যায় পড়ি। অনেক বড় বড় ব্যাংক-বিমা, সেবাদাতা ও আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে দিনের পর দিন গেছি। তারা সবাই আশ্বাস দিয়েছে কিন্তু সহায়তা করেনি। অবশেষে এগিয়ে আসে কিছু বেসরকারি সংস্থা, বিদেশি কিছু প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা।’—বলছিলেন মহরম আলী। তবে তিনি আর্থিক বাধার চেয়ে বড় বিপাকে পড়েন ভিসা নিয়ে। নিজের চেষ্টায় সব সমস্যা বরাবরের মতোই উতরে যান মহরম। ‘আমার লক্ষ্য ছিল, যেকোনো মূল্যে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে পৌঁছাব। আমি সেই লক্ষ্যে এগিয়ে গেছি। ভ্রমণের সময় কখনো বাস, কখনো ট্রেন, কখনো জাহাজ ব্যবহার করেছি।’

 
শহীদ মিনার থেকে শুরু
২০১১ সালের ২৫ জুন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেন মহরম আলী। প্রথমে বাসে করে তিনি যান ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। সেখানে থাকতে হয় ৩৪ দিন। ভারত থেকে সংগ্রহ করেন আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড, শেনজেন ও কাজাখস্তানের ভিসা। তারপর তিনি যান নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে। সেখানে কাটান ছয় দিন। প্রয়োজনীয় অনুমতি সংগ্রহের পর তিনি যান কাজাখস্তান। তারপর পৌঁছান রাশিয়ার মস্কোয়। মস্কোয় ছিলেন ১৯ দিন। এর মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মস্কো, বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ, অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোপিয়ান বিজনেস (এইবি) এবং আরও কিছু সংগঠনের সঙ্গে। তারপর তিনি ইউক্রেনিয়ান ট্রেনে করে যান ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। সেখানে বাংলাদেশি ছাত্রদের আমন্ত্রণে ভ্রমণ করেন অন্য দুটো বড় শহর। ১৫ দিন ইউক্রেনে কাটিয়ে ১ অক্টোবর ট্রেনে চেপে পোল্যান্ডে ঢোকেন। এক দিন পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে কাটিয়ে ওয়ারশ-বার্লিন এক্সপ্রেস ট্রেনে মহরম আলী জার্মানির রাজধানী বার্লিনে যান। সেখান থেকে যান ছোট্ট দেশ লিখটেনস্টেইনে। ৩৫ হাজার মানুষের ছোট্ট এই দেশে মহরম আলী কাটান ৪০ মিনিট। সেখান থেকে রেড বুল এনার্জি ড্রিংক কোম্পানির আমন্ত্রণে পৌঁছান অস্ট্রিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী সলসবুর্গে। কথা বলেন অস্ট্রিয়ান ন্যাশনাল হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দল, রেড বুল অথোরিটি এবং রেড বুলের অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান হাঙ্গার সেভেনের সদস্যদের সঙ্গে। তিনি আরও যান— সুইজারল্যান্ড ও ইতালিতে। এরই মধ্যে ২১ অক্টোবর জার্মানির প্রভাবশালী পত্রিকা স্পিগেল মহরম আলীকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর সুবাদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্রমণের আমন্ত্রণ আসতে থাকে তাঁর কাছে। জার্মানির ছোট্ট শহর হফে প্রতিবন্ধীদের একটি স্কুলের আমন্ত্রণে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। মহরম কথা বলেন, তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং ওয়ার্ল্ড ডিজঅ্যাবিলিটি ফান্ড নিয়ে। ১১ নভেম্বর মহরম আলী লন্ডনে পৌঁছান। তাঁকে লন্ডনে বরণ করে নেন তাঁর সাবেক সহকর্মী পাপ্পু লাল ও তাঁর সহপাঠীরা। ২৩ নভেম্বর এডিডি (অ্যাকশন অন ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) বাংলাদেশের দেশীয় পরিচালক মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন লন্ডনে। এডিডির আমন্ত্রণেই ২৯ নভেম্বর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তিনি অংশ নেন একটি আন্তর্জাতিক আলোচনায়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন লেবার পার্টির ডেভিড ব্লাংকেটসহ ব্রিটেনের আরও অনেক সংসদ সদস্য। ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের সদর দপ্তরে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে তাঁর ওয়ার্ল্ড ডিজঅ্যাবিলিটি ফান্ড ধারণাটি আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেন। তারপর দেশে ফেরেন ২৮ ফেব্রুয়ারি। তাঁর এই ভ্রমণের বিস্তারিত দেখা যাবে www.bezgraniz.ru ওয়েবসাইটে।

 
না, শুধু প্রতিবন্ধীদের সহায়তায় তাঁর প্রাণের দাবিটি জাতিসংঘ অবধি পৌঁছে দিয়েই থামেননি মহরম। প্রতিবন্ধীদের পাশে থাকতেই নাটোরে গড়ে তুলেছেন ‘ইউনাইটেড অ্যাকশন’ নামের একটি সংস্থা। তাঁর সঙ্গী ৩২ জন সদস্যকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিবন্ধীদের জন্য। মহরম আলী বলছিলেন, ‘আমরা শুরুতে প্রতিবন্ধীদের পেশাদারি প্রশিক্ষণ এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার ওপর জোর দিচ্ছি। সামনে আমরা আরও বড় পরিসরে কাজ শুরু করব। শুরুতে উত্তরবঙ্গের প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করব। তারপর সারা দেশ। এর মধ্যে যদি ওয়ার্ল্ড ডিজঅ্যাবিলিটি ফান্ডের ধারণা নিয়ে কাজ শুরু হয়, তাহলে তো খুব ভালো। যা-ই ঘটুক প্রতিবন্ধীদের নিয়েই আমি কাজ করে যেতে চাই।’



 মো. রুবেল 
তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, বাংলাদেশ। 
 


তথ্যসূত্র : প্রথমআলো

aas