Background

দুর্ঘটনাঃ নিয়তি বাংলাদেশের মানুষের, অপারগতা প্রশাসন ব্যবস্থার; নিয়তি বলে আর কতকাল কাটাতে হবে?

প্রতিদিন খবরের কাগজে দুর্ঘটনার নানাবিধ সংবাদ আমাদেরকে মর্মাহত করে।  দুর্ঘটনা কারো জীবনেই প্রত্যাশিত নয়। বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে এবং ঘরে-বাইরে যে সমস্ত দুর্ঘটনা ঘটে  থাকে, সেগুলির পেছনে কারন খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, ত্রুটি অনেকাংশেই সংশ্লিষ্ট  কতৃপক্ষের।  অথচ এই সমস্ত ঘটনা ঘটার পর মানুষের জীবনে যে  অবস্থা্র  সৃষ্টি হয়, তার যন্ত্রনা কাতর বোঝা তাকে ঠি্কই সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। কেউ কেউ একে নিয়তি বলি, আবার কেউ বা বলি  কর্মের ফল। একবার বসে ভাবা  উচিত, ব্যপারটা আসলে কি!? যাই হোক, গত দুই দিনে বংলাদশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার  কয়েকটি চিত্র নীচে তুলে ধরা হলো, যেগুলি  দেখলে বিবেকের দংশনে কষ্ট আর আফসোস ছাড়া কিছুই হয়নাঃ 

টমটম ও ট্রাকের ধাক্কায় দুই শিশুসহ তিনজন নিহতঃ



কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলায় টমটমের চাপায় দুই শিশু নিহত হয়েছে। গতকাল সোমবার উপজেলার উত্তর কান্দাইল গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। একই দিন নেত্রকোনা সদর উপজেলায় ট্রাকের চাপায় এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। করিমগঞ্জ থানা সূত্রে জানা গেছে, নিহত শিশু হীরামণি (৫) উপজেলার সিংগুয়া গ্রামের মঞ্জিল মিয়ার ও আশামণি (৬) কালিপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে। শিশু দুটি সম্পর্কে খালাতো বোন। তারা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে কালিপুর গ্রাম থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উত্তর কান্দাইল গ্রামে নানাবাড়ি যাচ্ছিল। বিকেল চারটার দিকে তাদের অটোরিকশাটি উত্তর কান্দাইল গ্রামে পৌঁছায়। অটোরিকশা থেকে নামার পর একটি টমটম এসে তাদের চাপা দিয়ে পাশের ধান খেতে উল্টে পড়ে। গুরুতর অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে তারা মারা যায়। নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ সড়কের চল্লিশা বাজারে গতকাল সকাল পৌনে ১০টায় ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে মোটরসাইকেল আরোহী আশিষ কুমার সাহা (৩৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।



সিএনজি স্টেশনে বিস্ফোরণ, নিহত ১  

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার বরঙ্গাইল এলাকার একটি সিএনজি স্টেশনের কমপ্রেশার বিস্ফোরণে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। দগ্ধ হয়েছেন কমপক্ষে ছয়জন। আজ সোমবার বিকেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে।নিহত ব্যক্তির নাম হেলাল উদ্দিন (৫০)। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায়। আহত ব্যক্তিরা হলেন মো. পাখি (৪০), মো. সালাউদ্দিন (৩৫), আশরাত আলী (৪৩), দেলোয়ার হোসেন (৪০), মাসুম হোসেন (৪৮) ও লেবু মিয়া। হতাহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই সিএনজি স্টেশনের কর্মচারী বলে জানা গেছে।
 

 
পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, নিহত ১

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাশিমপুর এলাকার মেগা ইয়াং ডায়িং নামে একটি পোশাক তৈরি কারখানায় গতকাল রোববার অগ্নিকাণ্ডে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আগুন নেভাতে গিয়ে আহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ পাঁচজন।
ফায়ার সার্ভিস ও কারখানা সূত্রে জানা গেছে, ওই কারখানার চারতলার সুতার গুদামে রোববার ভোরে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তে তা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে কালিয়াকৈর, সাভারের ইপিজেড, টঙ্গীসহ ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর সকাল নয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। 



ট্রাকচাপায় প্রাণ গেল ভাইবোনেরঃ

সাতক্ষীরায় ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ভাই-বোন নিহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকাল সাড়ে সাতটায় সাতক্ষীরা-আশাশুনি সড়কের জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন সাতক্ষীরা শহরের পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জলিলের ছেলে মেহেদী হাসান তামিম (১৯) ও মেয়ে সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তৌফিকা জাহান রুহিনা (১১)। মেহেদী এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন।

 

সেপটিক ট্যাংকের গ্যাসে দুজনের মৃত্যুঃ

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে এক নির্মাণশ্রমিকসহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ হয়েছেন আরও দুজন। কাল সোমবার সকালে উপজেলার আলীনগর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত দুজন হলেন ফরহাদ (২৯) ও শাহাদাৎ হোসেন (২৮)। তাঁদের মধ্যে নির্মাণশ্রমিক ফরহাদের বাড়ি উপজেলার মদনগঞ্জ সোহেলবাড়ির ঘাটে ও শাহাদাতের বাড়ি আলীনগরে। অসুস্থ দুজন হলেন নির্মাণশ্রমিক সুমন মিয়া (৩৮) ও নাজিম (৪৫)। তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এলাকাবাসীর বরাত দিয়ে বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নজরুল ইসলাম জানান, সকাল নয়টার দিকে আবদুল মালেক মিয়ার বাড়ির সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে নামেন নির্মাণশ্রমিক ফরহাদ ও সুমন মিয়া। তাঁদের সঙ্গে আবদুল মালেকের ছেলে নাজিম ও আত্মীয় শাহাদৎও নামেন। বিষাক্ত গ্যাসে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পরে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা শাহাদাৎ ও নির্মাণশ্রমিক ফরহাদকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। অসুস্থ সুমন মিয়া ও নাজিমকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ওসি নজরুল আরও জানান, নিহত দুজনের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হবে। সেপটিক ট্যাংকের বিষাক্ত গ্যাস থেকে এ ঘটনা ঘটেছে।

 

 বাস-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে যুবক নিহতঃ 

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌর সদরের শেখপাড়া এলাকায় যাত্রীবাহী একটি বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে মো. রিফাত (১৯) নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। কাল সোমবার বেলা তিনটার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
ওই দুর্ঘটনায় আরও চারজন আহত হয়েছেন। তাঁদের প্রথমে সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে তিনজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। নিহত রিফাত উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের কেদারখীল গ্রামের মোহাম্মদ সেলিমের ছেলে।



 গলাচিপায় মালবোঝাই ট্রলারডুবিঃ

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি লঞ্চঘাটের কাছে আগুনমুখা মোহনায় গতকাল রোববার সকালে একটি মালবাহী ট্রলার ডুবে গেছে। ডুবে যাওয়া ট্রলারটির মাঝি গলাচিপার বড়চরকাজল ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. ইয়ামিন পালোয়ান জানান, তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়ীর মালামাল নিয়ে গতকাল সকাল সাতটায় গলাচিপার আড়তপট্টি এলাকা থেকে চরকাজল-চরবিশ্বাসের উদ্দেশে রওনা হন। আটটার দিকে ট্রলারটি উপজেলার পানপট্টি লঞ্চঘাটের কাছে কাজল নদের আগুনমুখা মোহনায় ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। এ সময় ট্রলারটির আটজন যাত্রী এবং তিনজন মাঝি সাঁতরে ঘাটে উঠতে সক্ষম হন। 

রাজধানীতে পৃথক ট্রেন দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু:

রাজধানী ঢাকায় আজ মঙ্গলবার পৃথক দুটি ট্রেন দুর্ঘটনায় বেলায়েত হোসেন (৬০) নামের এক ব্যবসায়ী ও অজ্ঞাতপরিচয় (আনুমানিক ৪৫) নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বেলা তিনটার দিকে বাসাবো এলাকার রেললাইনে আহত অবস্থায় পড়ে থাকেন বেলায়েত হোসেন। তাঁর দুই পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ঘটনাস্থল থেকে বেলায়েত হোসেনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন রেলওয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারী মো. আবু শাহজাহানসহ আরও কয়েকজন। বিকেল চারটার দিকে বেলায়েতকে চিকিত্সকেরা মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বনানী রেলগেটের সামনে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। লাশটি উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
ঘটনা দুটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন কমলাপুর রেলস্টেশন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মজিদ। তিনি প্রথম আলোকে জানান, ওই ব্যক্তির নাম-ঠিকানা জানা যায়নি। তবে তিনি হিন্দুধর্মাবলম্বী ছিলেন বলে তাঁরা ধারণা করছেন।

 


গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনার কারণঃ চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, দক্ষতারঅভাবঃ 
 
এক গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে মূলত চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, দক্ষতার অভাব, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, রাস্তার নকশায় ত্রুটি, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করা হয়েছে। সাভার উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য জানানো হয়। ব্র্যাক আয়োজিত এ সভায় পিপিআরসি ও ব্র্যাকের যৌথ গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। গবেষণার ফলাফলে জানানো হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে চার হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় পাঁচ হাজার আহত হন। হতাহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই গ্রামের কর্মক্ষম মানুষ।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন ব্র্যাকের নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান। সভায় উপস্থিত ছিলেন সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান মোল্যাসহ যানবাহন মালিক ও শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। ফলাফল থেকে জানা যায়, দেশে ২১ হাজার ৬৩৫ কিলোমিটার জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় সড়ক রয়েছে। এসব সড়কে ২০১১ ও ২০১২ সালে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন তিন হাজার ১৩২ জন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে ও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মারা যান আরও দুই হাজার ৩০ জন। এভাবে বছরে গড়ে চার হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় পাঁচ হাজার আহত হচ্ছেন। বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই ঘটে দেশের নয়টি জাতীয় মহাসড়কের ৫৭ কিলোমিটার অংশে।

গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন শেষে মশিউর রহমান বলেন, সড়কে যানবাহন চলাচল ও পরিবহন বিষয়ে দেশে কোনো সমন্বিত আইন নেই। রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রাফিক অ্যাক্ট, ২০১১ নামে একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হলেও তা অনুমোদিত হয়নি। ইউএনও বলেন, ‘দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মারা যান কর্মক্ষম মানুষ। এটা আমাদের অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে। জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’



তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, বংলাদেশ।
তারিখঃ ৩০-০৯-২০১৪

aas