Background

২০১৩-১৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট; বিপাকে আছেন অর্থমন্ত্রী

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ক্ষেত্রে দুটি সূচক ওলট-পালট হয়ে গেছে। তিনি চেয়েছিলেন মূল্যস্ফীতির সূচক হবে কম, বিনিয়োগের সূচক হবে বেশি। কিন্তু এই দফায় পঞ্চম বাজেট দিতে গিয়ে দেখছেন, সূচকের যেন অদল-বদল হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির সূচক বেড়েছে, বিনিয়োগের সূচক কমেছে, বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কমে গেছে।  অর্থমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় বিপাক এই দুটি সূচক নিয়েই। কারণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ তাঁর দলের প্রথম অগ্রাধিকার। আর বিনিয়োগ বাড়ানো নিয়ে তিনি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মতো নতুন একটি ধারণা দিয়ে চমক দিয়েছিলেন। চার বছর পরও পিপিপি বাজেট বক্তৃতার মধ্যেই থেকে গেছে। যেমন বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

মহাজোট সরকারের শেষ বাজেটে অর্থমন্ত্রীর সামনে আরও চ্যালেঞ্জ আছে। "এই বাজেট হতে হবে জনতুষ্ট। কারণ, সামনেই নির্বাচন। রাস্তাঘাট বানানো আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার প্রবল চাপ এসেছে দলের ভেতর থেকেই। কর বাড়ানো চলবে না। পদ্মা সেতু নিয়ে দৃশ্যমান কিছু করতে হবে। আয় যাই হোক, ব্যয় বাড়াতে হবে। কারণ, শেষ সময়ে ব্যয় বাড়ানোর নানা চাপ রয়েছে অর্থমন্ত্রীর ওপর।" - ফলে বিশাল আকারের বাজেট দিতে হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে নতুন অর্থবছরের নতুন বাজেট। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বিশাল আকারের এই বাজেট অবশ্য বাস্তবায়ন করবে নতুন একটি সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলেছে, আগামী ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা থেকে আগামী অর্থবছরে ৩০ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা বেশি।

আগামীবারের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ধরা হয়েছে ১১ লাখ ৮৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, আর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে চলতিবারের জন্য প্রাক্কলন করা হারের সমান, অর্থাৎ ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৭ শতাংশ, চলতি বছর যা ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অনুদান বাদে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, অর্থাৎ ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। তবে অনুদানসহ হিসাব করলে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৮ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে অনুদানসহ রাজস্ব পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকছে এক লাখ ৭৪ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়া এবং বিদেশি অনুদান ছয় হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে অনুদানসহ রাজস্ব পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৪৫ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল। তিন ধরনের সংগ্রহের মধ্যে আগামীবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা, এনবিআর-বহির্ভূত করব্যবস্থা থেকে পাঁচ হাজার ১২৯ কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত পাওয়া বাবদ ২৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আগামী বাজেটে অনুন্নয়নমূলক ব্যয় ধরা হচ্ছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ব্যয় এক লাখ ১১ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা থেকে যা ২৩ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা বেশি। নতুন বাজেটে মোট উন্নয়নমূলক ব্যয় ধরা হচ্ছে ৭২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ছিল ৬০ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরে ৩২ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা থাকলেও বাজেট ঘাটতি মেটাতে আগামী অর্থবছরে সরকারকে ৩৩ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নিতে হবে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ২৫ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা এবং ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে সরকারের সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সাত হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে চার হাজার ৯৭১ কোটি টাকার পাশাপাশি অন্যান্য উৎস থেকে আরও তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে সরকারের।

অন্যদিকে আগামী অর্থবছরে ২৩ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে নিট বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকবে ১৪ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। কারণ, নয় হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হবে।  রাজস্ব কার্যক্রম: আগামী বাজেটের সবচেয়ে বড় দিক হলো বিনা প্রশ্নে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে। জমি, প্লট ও ফ্ল্যাট কিনতে এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। হস্তান্তর বা চুক্তিমূল্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিলেই অবৈধ অর্থে জমি বা প্লট কেনা যাবে। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ অর্থবছরে জমি বা প্লট কেনার সময় সাড়ে ৭ শতাংশ হারে কর দিয়ে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেটে (২০০৯-১০) ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক ফ্লোর কেনায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অভিজাত এলাকা ও অভিজাত এলাকার বাইরের ফ্ল্যাট কিনলে বিভিন্ন হারে প্রতি বর্গমিটারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে। আবার ২০০ বর্গমিটারের কম আয়তনের ফ্ল্যাটের জন্য আলাদা করহার থাকবে। এ ছাড়া ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আরও এক বছরের জন্য রাখা হচ্ছে। আর অপ্রদর্শিত বৈধ আয় প্রদর্শনের সুযোগেও কোনো পরিবর্তন আসছে না।

এদিকে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের বার্ষিক আয় করমুক্তসীমা দুই লাখ থেকে দুই লাখ ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হতে পারে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া মহিলা ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে পুরুষ করদাতাদের ক্ষেত্রে করমুক্তসীমা দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা করা হচ্ছে। আর প্রতিবন্ধী করদাতাদের তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত থাকবে। নারীদের জন্য পরিবার সঞ্চয়পত্রে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করলে এর মুনাফার ওপর কর মুক্ত রাখা হতে পারে। পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ উৎসে কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র—এই দুটি স্কিমে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী কেউ এই দুটি সঞ্চয়পত্রে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে মুনাফার ওপর করমুক্ত সুবিধা পাবেন। এ ছাড়া ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর ১০ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ উৎসে কর আরোপ হতে পারে। কর অবকাশ-সুবিধা ২০১৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখা হচ্ছে। ৩০ জুন কর অবকাশের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তবে কর অবকাশ-সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে ধরন পাল্টাবে।

অপেক্ষাকৃত অল্প দামি গাড়ির মালিকদেরও এবার করের আওতায় আনা হয়েছে। ১৩০০ সিসির গাড়ির মালিককে বার্ষিক ১০ হাজার টাকা করে কর দেওয়ার বিধান রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কস্তরের পরিবর্তন হতে পারে। মফস্বলের করদাতাদের ওপর বাধ্যতামূলক ন্যূনতম কর চাপানো হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ের করদাতাদের কমপক্ষে দুই হাজার টাকা ও উপজেলা পর্যায়ে এক হাজার টাকা করারোপ হতে পারে। অন্যদিকে সারচার্জের ক্ষেত্রেও কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। বর্তমানে দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিককে প্রদত্ত করের ওপর ১০ শতাংশ হারে সারচার্জ দিতে হয়। আগামী বাজেটে সারচার্জের ক্ষেত্রে সম্পদের পরিমাণভেদে স্তর করে দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া ফার্মের আওতায় গঠিত প্রতিষ্ঠানের অংশীদারদের কর শনাক্তকরণ সংখ্যা (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।

করপোরেট করের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন হতে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত মুঠোফোন কোম্পানির ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ কর আরোপ রয়েছে। এই করহার কিছুটা বাড়ানো হতে পারে। এদিকে আমদানি শুল্কস্তরেও কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর আমদানি শুল্ক ১ শতাংশ কমিয়ে ২ শতাংশ করা হতে পারে। আবার মধ্যবর্তী পণ্যে তা ২ শতাংশ কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। আর নয় স্তরের সম্পূরক শুল্কের পরিবর্তে ১০ স্তর করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নতুন স্তরে সম্পূরক শুল্কহার হতে পারে ১৫ শতাংশ, ২০ শতাংশ, ৪৫ শতাংশ, ৬০ শতাংশ, ১০০ শতাংশ, ১৫০ শতাংশ, ২৫০ শতাংশ, ৩৫০ শতাংশ ও ৫০০ শতাংশ। আর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্কস্তরের পণ্যের ওপর ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক অব্যাহত থাকবে। তবে মধ্যবর্তী পণ্যের আওতায় থাকা কয়েক শ ধরনের পণ্যের ওপর ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। এসব পণ্য মূলত মধ্যবর্তী পণ্যও নয়, আবার প্রস্তুতপণ্যের মধ্যেও পড়ে না। আবার পুরোপুরি ভোগ্যপণ্যও নয়। এ ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারে আরোপিত ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) প্রত্যাহার করা হচ্ছে। আবার কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনে স্পনসরশিপের ওপর ১৫ শতাংশ মূসক আরোপ হচ্ছে।








সুত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো 

aas