Background

কাজের তুলনায় মজুরি কম শিশুশ্রমিকদের

আট বছরের শিশু সাইদ কাজ করে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে একটি বেলুন তৈরির কারখানায়। বাবা ময়লার ভ্যানচালক। মা বাসাবাড়িতে কাজ করেন। সাইদ সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ করার পর বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাতে বাড়ি ফেরে। এত পরিশ্রমের পর সপ্তাহে জোটে মাত্র ৩০০ টাকা। অর্থাৎ মাসে এক হাজার ২০০ টাকা। সাজেদের বড় ভাই মো. রিটু (১৬) পাশের আরেকটি বেলুন তৈরির কারখানায় কাজ করে। বয়সে বড়, তাই শরীরে শক্তিও বেশি আর কাজেও দক্ষ বলে প্রতি সপ্তাহে ৫০০ টাকা করে পায় জানায়। সাইদ বলে, ‘মজুরি কম হইলে কি আর করতাম। যা দেয় তাতেই খুশি। আর কাম না করলে তো না খাই থাকন লাগে।’ ময়না (১২) গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে রাজধানীর আজিমপুরের একটি বাড়িতে। ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, ঘরবাড়ি গোছানো, থালাবাসন ধোয়া, বাচ্চা দেখাশোনা—এসব কাজ তাকে করতে হয়। মাস শেষে তাকে দেওয়া হয় এক হাজার টাকা। বেতন বাড়াতে বললে গৃহকর্ত্রী বলেন, ‘তোর খাওয়া আর জামা-কাপড়ের পেছনে অনেক টাকা যায়। এর বেশি দেওয়া সম্ভব নয়।’ তবে লাইলির অবস্থা আরও খারাপ। শান্তিবাগের একটি বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল আট মাস আগে। এই আট মাসে তাকে কোনো বেতন দেওয়া হয়নি।

রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাড়িতে কাজ করে ফরিদ (৮)। গৃহকর্তার ছেলে জিসানের (ছদ্মনাম) স্কুলের ব্যাগ বহন করা তার প্রধান কাজ। স্কুল শেষে জিসানের সঙ্গে সে হেঁটেই বাড়ি ফেরে। প্রায় একই বয়সের দুই শিশু একজন ব্যাগ টানার কাজ করে, আর অন্যজন স্কুল থেকে আইসক্রিম খেতে খেতে বাসায় ফেরে। জিসানের যখন স্কুল চলছিল, তখন কথা হয় ফরিদের সঙ্গে। সে জানায়, কাজ করে মাসে ৫০০ টাকা পায় সে। দুই বেলা খেতে দেয়। সকালে স্কুলে চলে আসে। তাই একবারে দুপুরে খায়, সকালে আর খাওয়া হয় না তার। স্কুলে যাতায়াত করা ছাড়াও ফরিদকে প্রতিদিন ময়লা ফেলা, ঘর মোছাসহ বিভিন্ন কাজ করতে হয়। ফরিদ বলে, ‘টেকার জন্যি বাবা-মায়ে কামে পাডাইছে। সেই টেকাই পাই না।’
 
হিরণ মিয়া লেগুনায় হেলপারের কাজ করে। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাবা বসিলায় রিকশা চালান। বাবার ইচ্ছায় স্কুলে না গিয়ে সে কাজে এসেছে। বেতন কত জিজ্ঞেস করতেই হিরণ বলে, ‘বেতন কী আফা?’ প্রতি ট্রিপে ২০ টাকা করে দেয়। আবার যাত্রী বেশি না হলে তা-ও পায় না কখনো। হিরণ বলে, ‘এসব টাকায় সংসার চলবার চায় না। কিন্তু কী করুম। এই কাম না করলে তো আরও বিপদ। খামু কী।’ হিরণ জানায়, একবার লেগুনার হ্যান্ডেল থেকে হাত ফসকে পড়ে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছিল। তখন দুই মাস পঙ্গু হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল তাকে। রাজধানী কারওয়ান বাজারের একটি দোকানে কাজ করে ১০ বছরের শিশু শিপন। মাস শেষে সে পায় ৮০০ টাকা। সারা দিন কাজ করলেও মালিক তাকে কোনো বেলায়ই খেতে দেন না। শিপন বলে, ‘সংসারে যাতে টেকা দিবার পারি, হের লাইগ্যা এইহানে কাম করতে আইছি। কিন্তু যে বেতন পাই, এই দিয়া তো ঠিকমতো খাওনই জুডে না।’

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) চেয়ারপারসন এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, শিশুরা ভোটার নয়, তাই শিশুদের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর খুব একটা মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার হলেও তাদের উন্নয়ন নিয়ে কেউ খুব একটা চিন্তিত নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ১৪ বছরের নিচে বয়স, এমন শিশুদের শ্রমে নিয়োগ দেওয়া নিষিদ্ধ হলেও অনেকে এ বিষয়ে জানে না। আবার জানলেও তারা শ্রমিক হিসেবে শিশুদের নিয়োগ দিতেই পছন্দ করে। এ ব্যাপারে সরকারকে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। শিশুশ্রমিকেরা যাতে যথাযথ মজুরি পায়, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।
- সাবিনা ইয়াসমিন 

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা

আবদুর রহিমের বয়স ১০ বছর। সে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে একটি লেদ কারখানায় কাজ করে। মলিন মুখ, শরীরের এখানে-সেখানে কালিমাখা, হাতে কাটাছেঁড়ার দাগ আর ধুলামাখা চুল তার। রংচটা পোশাকেও অনেক দাগ লেগে আছে। ১৮ মার্চ রাত ১০টায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যখন রহিমের কথা হয় তখন সে কারখানার সারা দিনের জমে থাকা ময়লা ঝাড়ু দিচ্ছিল। রহিম জানায়, সকাল নয়টায় কারখানায় এসেছে। রাত ১১টায় কারখানা বন্ধ হলে তবেই ঘরে ফিরবে। এভাবেই এক বছর ধরে এ কারখানায় কাজ করছে। সারা দিন লোহা কাটার জন্য হাতুড়ি পেটানো, ভারী লোহার যন্ত্র আনা-নেওয়া, লোহা কাটা, মেশিন মেরামতসহ নানা ধরনের কাজ করতে হয় তাকে। এ কাজ করতে গিয়ে অনেকবার তার হাত কেটে গিয়েছে। হাতে ব্যথাও পেয়েছে অনেকবার। এ ছাড়া কারখানার কাজের পাশাপাশি মালিকের ফরমাশও মেনে চলতে হয় তাকে।

ধানমন্ডি ১৫ নম্বর সড়কে একটি ওয়ার্কশপে কাজ করে মহিন মিয়া (১২)। এখানে লোহা ঝালাইয়ের কাজ করে সে। প্রতিরোধক হিসেবে চশমা ব্যবহারের কথা থাকলেও শিশুটির চোখে তা নেই। হাজারীবাগের চামড়া কারখানার বর্জ্য যেখানে গিয়ে পড়েছে, সেখানে টুকরা টুকরা চামড়া কুড়ানোর কাজ করে ১১ বছরের হিরণ। রাসায়নিকমাখা বর্জ্য থেকে সে চামড়া কুড়িয়ে তা শুকানোর পরে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে। এ ছাড়া পশুর শিং, হাড়ও কুড়ায় সে। হিরণ জানায়, এ কাজ করতে তার ভালো লাগে না। বাধ্য হয়ে করে। বাবা পঙ্গু, কাজ করতে পারে না। মা পরের বাড়িতে কাজ করে। সংসারে আরও ছোট দুই বোন আছে তার। সবার কথা চিন্তা করেই সে কাজে নেমেছে।

জিগাতলা থেকে ফার্মগেটে যাওয়া হিউম্যান হলারে হেলপারের কাজ করে ফিরোজ (১২)। প্রতিদিন ঝুলতে ঝুলতে সে কাজ করে। কয়েক দিন আগে সে হলার থেকে পড়ে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যথা পায়। ফিরোজ বলে, ‘যাত্রী উডানোর পর আমারে ছাড়াই গাড়ি রওনা দেয়। দৌড় দিয়া গাড়িতে উঠছি ঠিকই, কিন্তু তাল সামলাতে না পাইরা পইড়া যাই। এরপর সাত দিন কামে আইতে পারি নাই, হেই সাত দিনের বেতন কাডা গেছে।’ নয় বছরের শিশু নাজমা কাজ করে রাজধানীর মালিবাগের একটি বাড়িতে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া সবই করতে হয় তাকে। এক দিন ভাতের ফ্যান গলাতে গিয়ে গরম ফ্যান হাতে পড়ে। এতে তার হাত পুড়ে যায়। আরেক দিন বাসায় পানি ছিল না। নিচে রিজার্ভ ট্যাংক থেকে বালতি ভর্তি করে পানি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নাজমা বালতিসহ পড়ে যায়। এতে তার পা মচকে যায়।

দেশে বিদ্যমান শিশু আইনে শিশুদের দিয়ে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো সম্পূর্ণ বেআইনি। সরকার ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ১৮২ নম্বর সনদে স্বাক্ষর করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বহু শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। এসব কাজ করতে গিয়ে শিশুরা নানা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া অনেকে নানা রোগব্যাধিরও শিকার হচ্ছে। তাদের মানসিক বিকাশও ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ঠিক কত শিশু কাজ করে, এ ধরনের কোনো পরিসংখ্যান জানে না শ্রম মন্ত্রণালয়। এমনকি কী কী ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে তারও সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা নেই তাদের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে বর্তমান কোনো পরিসংখ্যান নেই।’ তিনি জানান, কোনো কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে তাঁর সুনির্দিষ্ট তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই, তবে এ বিষয়ে আমাদের ধারণা আছে। তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের ফিরিয়ে আনতে সরকার একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। এর আওতায় ৫০ হাজার শিশুকে এসব কাজ থেকে ফিরে এনে শিক্ষা, ভাতা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এটি বর্তমানে তৃতীয় পর্যায়ে চলছে। শিগগিরই চতুর্থ পর্যায়ে বর্ধিত করা হবে।

দীর্ঘদিন ধরে দেশে এবং বিদেশে মানবদেহে ঢুকে পড়া ক্রোমিয়ামের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবুল হোসেন। তিনি জানান, চামড়াশিল্পে ব্যবহূত রাসায়নিক মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। চামড়া শিল্পগুলোতে পশুর চামড়া প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রচুর ক্রোমিয়াম ব্যবহূত হয়। ট্যানারি শিল্পে শিশুরা যেভাবে খালি গায়ে ও খালি হাতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে, তাতে এ রাসায়নিক প্রবেশ করে তাদের ফুসফুসে ও চামড়ায় ক্যানসার হতে পারে। এ ছাড়া নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দিতে পারে।
 
এ প্রসঙ্গে বারডেম হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান তাহমিনা বেগম বলেন, প্রতিরোধক ছাড়া ঝালাই কারখানায় কাজ করার কারণে শিশুরা অল্প বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারায়। বিভিন্ন স্থানে সঠিক কর্মপরিবেশের অভাবে শিশুরা ময়লা হাতেই খাবার খায়। এতে শিশুদের নানা ধরনের পেটের অসুখ হয়ে থাকে। যেসব শিশু বাসাবাড়িতে কাজ করে তাদের দিয়ে ভারী বালতি টানা, কাপড় ধোয়ার মতো কঠিন কাজ করানো হয়। এতে মেরুদণ্ডে ক্ষতি হয়। আর বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে শিশুরা যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, তাতে করে তারা মানসিকভাবে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এতে তাদের মানসিক বিকাশও ব্যাহত হয়।




তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, বংলাদেশ।

aas