Background

রাজনৈতিক সমঝোতার কোন বিকল্প নেই

 দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রশ্নে জনগণের মধ্যে একধরনের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। সরকারি দল তার নির্বাচনী ইশতেহারে অনেকগুলো উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক ও অবকাঠামোগত এজেন্ডার কথা জনগণের কাছে তুলে ধরেছিল। এর মধ্যে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন, ঢাকার যানজট নিরসন, বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসন, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়নে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়নে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। বিশেষত, গত চারবছরে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন এবং বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসনে সরকার অনেক দূর এগিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্নে বিশ্বব্যাংকের সাথে বনিবনা না হওয়ায় এডিবি, জাইকা ও আইডবি’র পশ্চাতপসারণের পর পদ্মাসেতুর কাজ শুরু করাই সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতে বিগত জোট সরকারের রেখে যাওয়া ঘাটতিসহ ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ছিল অনেক বেশি সাহসী এবং গতিশীল। কিন্তু কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি ও ভর্তুকির নামে বছরে জনগণের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার বড় ধরনের দায় থেকেও সরকার বের হতে পারছে না। গত ৪ বছরে ৬ বার জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও ভর্তুকির দুর্বহ বোঝা লাঘব করা যাচ্ছে না। একদিকে দেশের পুরনো বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি সরবরাহ ও ওভারহোলিংয়ের অভাবে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখতে পারছে না, অন্যদিকে বিদ্যুৎঘাটতি দ্রুত পূরণের লক্ষ্য নিয়ে নানা ধরনের আইনগত সুবিধা দিয়ে বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়া হলেও কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো গত চারবছরে দেশে বড় ধরনের শিল্প বিনিয়োগের উপযুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জন দূরের কথা, চলমান ঘাটতিই পূরণ করতে পারেনি। গত ৪ বছরে রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির কোন লক্ষণীয় অগ্রগতি দেখা যায়নি। তবে ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত বনানী ওভারব্রিজ ও হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্প রাজধানীর উত্তরাংশের যানজট কিছুটা কমিয়ে আনার পাশাপাশি সৌন্দর্য বর্ধন এবং যান চলাচল নিরাপদ ও নির্বিঘœ করতে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। এটা সরকারের বড় সাফল্য বলা যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবি একটি সার্বজনীন দাবি হয়ে উঠলেও দীর্ঘ ৪০ বছর পর এ ধরনের স্পর্শকাতর ও জটিল বিষয়ের আইনগত ও রাজনৈতিক মীমাংসার প্রশ্নে সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের দরকার ছিল চলমান বাস্তবতায় তার ঘাটতি প্রকট আকারে ধরা পড়ছে। একনম্বর ট্রাইবুনালের প্রথম প্রধান বিচারক নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ আলাপের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর শুধু বিএনপি-জামায়াতই নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম এবং মিডিয়াও একে ‘বিতর্কিত ট্রাইবুনাল’ বলে আখ্যায়িত করার সুযোগ পেয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল থেকে পাস হওয়া প্রথম রায়ে পলাতক আসামি মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ জারি হওয়ার পর বিদেশি অনেক মিডিয়া একে বিতর্কিত ট্রাইবুনালের রায় বলে আখ্যায়িত করেছিল। লাখো মানুষের প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের চারদশক পর দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধের সময় বেসামরিক নাগরিক হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের সাথে জড়িতদের বিচারে এক ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তখন এই বিচার প্রক্রিয়ায় বিতর্কিত হয়ে পড়া কাক্সিক্ষত নয়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল বাতিলের দাবিতে গত সপ্তাহে রাজধানীসহ জামায়াত-শিবিরের তা-ব ও হরতালে পুলিশসহ পাঁচজন নিহত ও কয়েকশ’ ব্যক্তি হতাহত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই রাজধানীতে জামায়াত শিবিরের মিছিল-মিটিংয়ে অনেকটা অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। পুলিশের অনুমোদন না থাকায় জামায়াত-শিবির মাঝে মধ্যেই ঝটিকা মিছিল ও পুলিশের উপর চোরাগোপ্তা হামলা করে আসছিল। জামায়াত থেকে অনেক আগেই বহিষ্কার হওয়া মাওলানা আজাদের কোন রাজনৈতিক পরিচয় না থাকা এবং তার অনুপস্থিতিতে ট্রাইবুনালে তার পক্ষে কোন সাক্ষি বা আইনজীবী না থাকায় তার বিরুদ্ধে ট্রাইবুনালের ফাঁসির আদেশ তেমন কোন রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেনি। তবে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মঙ্গলবার ট্রাইবুনালের রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারিত ও প্রকাশিত হওয়ার একদিন আগে কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো সরকারের অনুমতি নিয়ে জামায়াত-শিবির রাজধানীতে সমাবেশ করেছে। শিবির-জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মীর সমাবেশ হলেও এই সমাবেশ মারমুখী বা ধ্বংসাত্মক ছিল না। চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতার উন্নয়ন বা সমঝোতা না হলেও বিরোধী জোট ও জামায়াতের পক্ষ থেকে দেশে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কার কথাও বলা হয়েছে।
বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার লেখা একটি নিবন্ধ সম্প্রতি (৩০ জানুয়ারি) ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর সে নিবন্ধ নিয়ে শুরু হওয়া রাজনৈতিক বিতর্ক টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। একই সময়ে ‘পদ্মাসেতু প্রকল্পে কথিত দুর্নীতির স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের শর্তসমূহ পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন সম্ভব নয়’, বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের এমন ঘোষণার পর এই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য সরকারের দেয়া চিঠি প্রত্যাহার করে নেয়ার পর এডিবি, জাইকা এবং আইডিবি’ও তাদের প্রতিশ্রুত অর্থায়ন বাতিল করেছে। খালেদা জিয়ার নিবন্ধে বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিকে চাপ সৃষ্টি বা ভূমিকা পালনের আহবান জানানো হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের এ ধরনের আহ্বানকে সরকারি দলের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে জাতীয় সংসদে আলোচনা করা হয়েছে। ওয়াশিংটন টাইমস-এ প্রকাশিত নিবন্ধটি ঢাকার ডেইলি স্টার পত্রিকায় হুবহু এবং কয়েকটি বাংলা দৈনিকে অনুবাদ হয়ে ছাপা হয়েছে। প্রকাশিত নিবন্ধ, অনুবাদ এবং এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনে নানা রকম মিশ্র মতামত দেখতে পাওয়া যায়। দেশীয় রাজনৈতিক সঙ্কট এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যায় বিরোধীদলের বিদেশি হস্তক্ষেপের আবদার কোন নতুন বিষয় নয়। অতীতে বর্তমান সরকারি দলের নেতারাও বর্তমান বিরোধীদল সরকারে থাকার সময় অনুরূপ বিদেশি হস্তক্ষেপের দাবি  করেছিলেন বলে বিরোধীদলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ও দাতাদের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ার সংবাদটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জিং ও দুঃসংবাদ। আর এই সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা আরেকটি দুঃসংবাদ হিসাবে গণ্য হচ্ছে। জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতি, আন্তর্জাতিক রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে এ দু’টি বিষয়ই বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রেও দেশের সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপ ও ব্লেইম-গেইমের পুরনো চিত্রই প্রতিফলিত হতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের চার বছর পার হয়ে যাওয়ার পর জনগণ যখন চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে শুরু করেছেন, তখন একদিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমে উত্তপ্ত ও যুদ্ধংদেহি হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক রফতানি বাণিজ্য, শ্রমবাজার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ নতুন ও কঠিনতর চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ক্ষমতায় যে দলই থাকুক, দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং জনগণের মৌলিক অধিকার অন্যসব রাজনৈতিক প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন, এই সত্যকে নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা, একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের পাশাপাশি প্রফসর ইউনুস ও গ্রামীণব্যাংক পরিচালনার মতো আমাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলো নিয়ে সরকার এবং বিরোধীজোটের মধ্যে ন্যূনতম রাজনৈতিক সমঝোতা ও মতৈক্য না হওয়ার প্রভাবে দেশের রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।
পদ্মাসেতুর অর্থায়ন বন্ধ, জিএসপি সুবিধা বাতিলের শংকা ইত্যাদি বৃহত্তর ইস্যুগুলো ¯্রফে বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তের ফল নয়। এর পেছনে দেশে রাজনৈতিক বিভাজন এবং সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার দায় রয়েছে। এহেন বাস্তবতায় দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং জনগণের শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত রাখতে সব ধরনের রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত ইগো পরিহার করে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি ন্যূনতম রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছতেই হবে।
 

জামালউদ্দিন বারী, দৈনিক ইনকিলাব 

aas